Monday, October 21, 2013

একটা খেয়ালি আত্নহত্যা পরিকল্পনা এবং বেঁচে থাকা যেমন


গল্পটার শেষটুকু খুব তাড়াহুড়া করা, আসলে লিখছিনা এই ভাবনাটা বয়ে বেড়ান আমার জন্য খুব কঠিন- যতটুকু আরোপ তা মেরামতসম্ভব.

 শহরটা কুয়াশা-গ্রস্থ হয়ে পড়লে সোডিয়াম বাতি এক বিবর্ণ ধূসর-মেরুন রং লেপ্টে দেয় তার সড়কগুলোতে।
রাস্তার পাশেই পাবলিক লাইব্রেরী, শহীদ মিনার আর নাটক পাড়া।ওখানে আঁধার কিছুটা ফিকে, একটা ৬০ কি ৮০ ওয়াটের বাল্ব, পান খাওয়া দাঁতের মত লালচে এবড়ো থেবড়ো ইলেকট্রিক তারের সাথে লটকে কুয়াশার চাদরে খানিকটা তালি-ছাপ্পা মেরে দিয়েছে।

"হিরুইঞ্চি শালাদের জন্য যদি একটাও ভাল লাইট থাকে"- এমন অভিযোগ নিয়মিত উচ্চারিত হয়। যদিও লাইটগুলো মূলত ভাঙ্গে প্রেমিকদের হাতেই।
এইযে বিপুল আর চম্পা রিহার্সেল শেষে যখন শহীদ মিনারের পেছনের নির্জন জায়গাটায় বসবে হয়তো এই আলোর জন্য চম্পা হাতটা পর্যন্ত ধরতে দিতনা।
সুতরাং বিপুল বাতি ভাঙতেই পারে, কিংবা নোমান অথবা সাজ্জাদ। আলো প্রেম বান্ধব নয়।
আজ কিন্তু প্রেম জমেনি, গতকাল এর থেকেও ঘন কুয়াশায় এই অন্ধকারে হয়তো সাজ্জাদ সাবরিনার, কিংবা যুথি নোমানের শ্বাস গাঢ় হয়ে কুয়াশার সাথে মিতালী করেছিল

ডিসেম্বরের শীতে নটায় বেশ রাত হয়ে যায়। গাছ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দও তখন শুনছিল বিপুল। আর হটাৎ রাস্তায় রিক্সার টুংটাং শব্দ যেন শহরের এত বড় ইমারত দেয়ালের থেকে তার কানের পর্দাটাতেই ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে।
শালা খয়বার কি দোকান বন্ধ করবে না নাকি?”
প্রায় একশো গজ দূরে দুধের হাড়ি জ্বাল দেয়া আগুণ, কুয়াশায় জড়িয়ে জড়িয়ে যখন নিথর প্রায়, তার দীপ্তিতে চোখ কুঁচকানোর কোন কারণ নেই। কিন্তু বিপুলের চোখ জ্বলে।

এইতো তখনো সন্ধ্যা বলা যায় সময়টাকে, বেটে জেলা সংবাদদাতা আরিফ তার নববধূ চম্পাকে ভেসপার পেছনে বসিয়ে হটাৎ হাজির হয়েছিল। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে বেশ জানিয়ে গেল, তার বউ চম্পাকে মালাউন বিপুল নানাভাবে বিরক্ত করছে। শাসানির এক পর্যায়ে দুই একটা ধাক্কা দিলে চম্পা স্বামীকে বেশ সামলানোর ভঙ্গীতে ধরে, সেসময় চম্পার থেকে আধ হাত খানেক ছোট আরিফের নাকে চম্পার বুক ঘষা খায়। এই বুক ঘষা খাওয়ার দৃশ্যটা যেন বিপুল এখন বানিয়ে ফেলল, এতক্ষণ গোটা ব্যাপারটায় যে অপমান ছিল, লজ্জা ছিল সেটা যেন এই দৃশ্যটার কারণে বিপুলকে খানিকটা বেপরোয়া বানিয়ে তোলে। এতক্ষণ তার কুয়াশার ভেতরে আত্নগোপন যেন না ঘটা কোন ঘটনামাত্র, সেটা প্রমাণ করতেই শিস দেয়ার জন্য ঠোঁট গোল করে সে, এবং শীতের প্রকোপে তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট কোন শব্দ তৈরি করতে না পারায় তার বেপরোয়া হতে বিঘ্ন ঘটে

বিপুল-চম্পার প্রেমটা অনেকদিনের।
একদিন ক্লাস এইট নাইনে পড়া এক কিশোরী, যার নাকের নিচে কিছুটা গোঁফের রেখা, আকর্ষনীয় না হয়ে উঠা স্তন, ভীতু ভীতু চোখ নিয়ে চম্পা যেদিন তাদেরঅগ্নিনাটক গোষ্ঠীতে নাম লেখাল, তখন যাত্রা দলের নায়কদের মত ফর্সা গাল, যাতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নীল আর সবুজের আভা ফেলে, সুদর্শন বিপুল তখন শহরের নাটক পাড়ায় দারুণ জনপ্রিয়। প্রতিদিন কত মেয়ে যে তার দৃষ্টি আকর্ষন করতে গেছে। তখন এই ভীরু ভীরু কিশোরী চম্পা আর সুদর্শন বিপুলের প্রেম হয়ে গেল।চম্পার কিশোরীবেলাকে এমত এভাবে বর্ননা করার ভেতরে যেনিন্দাআছে, সেটাই বা ধ্রুব ধরবেন কেন? মা মরা মেয়েটার গুণ্ডা ভাইটা বাসায় একটা ত্রাস তৈরি করেছিল, আর তার বাপ মায়ের মরার পরপর যে তার খালাকে বিয়ে করে ফেলল, তার জন্য কিশোরীর মনোজগত আক্রান্ত হলে তার খানিক ছায়া যদি মুখে পরে তাহলে এতো কথারই বা কি মানে আছে? তাবাদেও নাট্য-দলে যোগ দেবার কিছুদিন আগে চম্পার টাইফয়েড হয়েছিল, সে ব্যাপারটা হিসেবে নিতে হবে।
কেউ যেন ভেবে না বসেন বিপুল বসন্ত হয়ে রং ছড়াল,বরং বলা যেতে পারে চম্পার স্বাভাবিক যে সৌন্দর্য তা যেকারনে তখন পর্যন্ত বিকশিত হয় নাই, মেয়েবেলার সাথে জড়িয়ে থাকা যে প্রতিবন্ধক তারই কারণে। চম্পা শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়নি বরং সে স্বভাব প্রজাপতি, যার ডানা তখনও বাতাসে ভাসার কৌশল শেখেনি।

তার বখাটে ভাইটা মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাওয়ার পর, সে যখন কলেজে তার কটা চোখ শিখে নেয় সমস্ত ভাষা, তার ধনুক মত ঠোঁট যখন নিঃশব্দ হাসিতে বেঁকে যেত, টানটান ছিলায় তীরের মত সেই হাসি নাটক-পাড়ায় কতজনকে বিদ্ধ করেছে, এমনকি শিল্পীদের হাত থেকে মোটামুটি বই বগলে বয়ে বেড়ান ঢাকা-ফেরত বুদ্ধিজীবিদের হাতে পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরের নিয়ন্ত্রন চলে গেলে, কত রথী মহারথী চম্পার সামনে বোকাবোকা হাসিতে লালায় ভিজিয়ে ফেলত তাদের উচ্চারণ।
কিন্তু এমন হুট করে তার বিপুলকে ছেড়ে বেটে ধান্দাবাজ আরিফকেই বিয়ে করতে হল? বিপুল এবার ক্ষেপে যায়, “আসলেই বেশ্যা একটা”- এবং বিগত প্রেমিকাবেশ্যাহয়ে তার কটা চোখ, উন্নত বুক, রমনীয় নিতম্ব নিয়ে বিপুলের কল্পনায় এলে বিপুল তৃপ্ত হয়। এই উত্তেজনা শীতের ভেতরে তাকে উত্তাপ দেয়। তলপেটের চাপ তাকে প্রস্রাবের প্রয়োজনে যখন দাঁড় করিয়ে দেয়, আর সব পুরুষদের মত উত্থিত শিশ্ন তাকে গর্বিত করে।

দেয়ালের যেই জায়গাটায় সে প্রস্রাব করার জন্য দাঁড়ায়, সেখানে লেখা ছিলজনগণই সকল ক্ষমতার উৎসসেটাকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ লিখেছিলবন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস”, যা এখন কুয়াশায় আর অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু বিপুল জিপার খুলতে খুলতে ক্ষমতার উৎসদ্বয়কে চ্যালেঞ্জ করে, মনেমনে।
সেসময় এক বেহুদা শীত তার শিশ্নকে আক্রমণ করে বসলে, ক্ষমতার যে ক্ষণস্থায়িত্ব সেটা মেনে নিয়ে সে নিভে যায়।
এতক্ষণ চেপে রাখার কারণেই হয়তো পথে খানিকটা জ্বলুনি অনুভব করে।

এখন কিন্তু বিপুল তার সমস্ত অসহায়ত্ব মেনে নেয়, চম্পার জন্য তার বুকে ভালবাসা উথলে উঠে। খয়বারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, এখন সে চোরের মত চত্বরের গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। সোডিয়াম লাইটের ঘোলা ঘোলা আলো কুয়াশায় কামড় বসিয়ে ক্ষত করতে না পারার ব্যর্থতা যেন বিপুলের চোখে তার সাধ মিটিয়ে নেয়।

বিপুলের বাবা মা নেই। সে এখন যে বাসাটায় থাকে, ওটা ওদেরই, বড় ভাই যশোরে চলে যাওয়ায় দখলের জন্য খুটি হিসেবে বিপুলকে রেখে গেছে, একটা ঘর, তার সংলগ্ন নিতিন কাকার চা পানের দোকান কেবল তাদের মালিকানায় আছে, বাকিটা বড় ভাই বেচে দিয়েছেন। বিপুল কখনোই নিজেকে বঞ্চিত ভাবে নাই, কিন্তু আজকে তার ভাইকে শঠ মনে হয়, মনে হয় তার প্রতি অন্যায় করেছে সে। এবার অন্ধকারে বিপুলের ছায়াও হারিয়ে গেলে বিপুল সত্যি সত্যি আলাদা হয়ে পরে। বাড়ির গলির সামনে যথারীতি নেশাখোরদের জটলা, গৃহহীন কেউ কেউ পলিথিন আর কাগজ জড়ো করে আগুণ জ্বালিয়েছে। পলিথিনের কালো ধোঁয়া কিন্তু গলির মুখে কুয়াশাকে বেশ শায়েস্তা করেছে।রাত কটা?হয়তো ১১টা। মানুষের সঙ্গ পেয়েই বিপুল এবার কিছুটা জীবন অনুভব করে।

গোলাপি নামের মেয়েটা, যে বিপুলের ঘরের মুখোমুখি বস্তিতে থাকে। গোলাপীর ব্যাপারে বিপুল সচেতন না হবার জন্য রীতিমত চেষ্টা করেছে। না করে উপায় কি? মেয়েটা বেশী মাত্রায় সরব, শরীরে কণ্ঠে। বিপুলের জানালা খুললেই দেখা যায় ওর ছাপড়া ঘরের ভেতরে তার উদ্ধত গ্রীবা, আর চোখ পড়লে সে চোখ নামাবে না। আর বিপুল যেহেতু চম্পার প্রেমে গভীর ভাবে জড়িয়ে ছিল, তার গোলাপীর দিকে তাকিয়ে সাময়িক যে ভাললাগা সেটাকে তাড়িয়ে দিত। গোলাপীর মা যখন তাদের বাড়িতে কাজ করত, বিপুলের মা বেঁচে থাকার সময়কার কথা, তখন পাশের যে বাড়িটা, যেটা ভাই মালাউন হওয়ার অপরাধে আধা মাগনা বেচে দিয়েছে, সেই বাড়িতে। গোলাপীর মাথা তখন ন্যাড়া, মাথায় বিশ্রী রকমের ফোঁড়া, তার উপরে সাদা পাউডার, তাদের রান্না ঘরের সামনে একটা বাটিতে মুড়ি নিয়ে তাকে বসিয়ে দিত বিপুলের মা। বিপুল গোলাপীর সেই ছবিটা দিয়ে এই অসম্ভব প্রাণবন্ত নারী হয়ে উঠা গোলাপীকে নাকচ করে দিয়েছে।
কিন্তু আজ গোলাপী যখন রাস্তায় নেশাখোর আর গৃহহীনদের আড্ডায় দাঁড়িয়ে ছিল চারদিকের প্রতি তুমুল তাচ্ছিল্য নিয়ে। বিপুলের স্বাভাবিক প্রবনতায় তাকে ফোঁড়া থাকা শিশু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে গিয়ে কিছু একটা ভজগট পাকিয়ে ফেলে। তার মায়ের শাড়ীর আঁচল আর ট্রেনের ঝমঝম শব্দ মাথা আর রক্ত অধিকার করে নেয়।
এবং বিপুল যা কখনোই ভাবেনি, এমনকি যখন অন্ধকারে ভীষণ লজ্জায় অন্ধকার হয়ে মিশে যেতে চাইছিল সেসময়ও- তার আত্নহত্যার সাধ জাগে।
আর ঘরে ফিরে সে ট্রেনে কাটা পড়ার একটা পরিকল্পনা করে। বিপুলের পরিকল্পনাকালীন ভাবনায় তার সাম্প্রতিক অস্বচ্ছলতাও তাকে আরো মরিয়া করে তোলে।
গোলাপীর জানালা ভোরে খুলে গেলে বিপুলের আত্নহত্যার প্রস্তুতি শুরু হয়।

গোলাপীর এনজিও আপাদের সাথে খুব খাতির তার। তার একটা ব্যবস্থা আছে, পুরুষদের বন্ধ্যাকরন একটা প্রোগ্রামের কোন এক আপার সাথে তার একটা লেনদেন আছে। পাড়ার বহু নেশাখোরদের একহাজার টাকার ব্যবস্থা সে করে দিয়েছে নিমিষেই। সকালে উঠে বিপুল গোলাপীর ছাপড়া ঘরের সামনে ঘুরঘুর করে। তার পরিকল্পনা ভীষণ নিখুঁত। আজ সন্ধ্যায় কোন একটা ট্রেনের নিচে কাটা পড়বে। তার আগে দিনটা সে হালকা স্বচ্ছল ভাবে কাটিয়ে দেবে।
গোলাপী তার দিকে তাকিয়ে বলেআপনিও কি লাইনে নামছেন?”, বিপুল উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করেনা।
গোলাপী বলেবিকালের আগে তো হবেনা”, বিপুল দ্বিধাবোধ করলে, গোলাপী বলে, “আচ্ছা আপনি বসেন, আমার কিছু কাম আছে, শ্যাষ হইলে আপনাকে নিয়া যাব”, বিপুলের রাতজাগা ফোলা চোখ দেখে গোলাপীর মায়া হয়ে থাকতে পারে

বিপুল গোলাপীর ছাপড়া ঘরে, বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমের ভেতরে ট্রেনের হুইসেল শোনে। লাইনম্যানের হাতের ফ্লাগটা তার মায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে বানানো!
তখন বিকেল, গোলাপী তার ঘুম ভাঙ্গায়। ওখানে তাকে কি কি বলতে হবে সংক্ষিপ্ত ভাবে বুঝিয়ে দেয়, এবং খুব স্পষ্ট করে জানায় ২০০ টাকা কিন্তু তাকে দিতে হবে।
গোলাপী আর বিপুল যখন লাইগেশন সেন্টার থেকে বের হয়, তখন সন্ধ্যা। আজ কুয়াশা পড়েনি তেমন, সোডিয়াম বাতিগুলোর হলদেটে আলো খুব মলিন মনে হচ্ছিল বিপুলের কাছে। তার গোলাপীর পাশে হাঁটতে ভাল লাগছিল। কি মনে করে সে গোলাপীকে বলেআইসক্রিম খাবা?”, গোলাপীর চোখে দ্বিধা দেখে সে ২০০টাকা তাকে দিয়ে দেয়। তারপর আইসক্রিম খাওয়া হলে, গোলাপী চলে যায়। বিপুল পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে হাঁটতে থাকে। তার নিজেকে আর রিক্ত লাগেনা। গালে হাত দিয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্য সে বিব্রত বোধ করে

 


 

No comments:

Post a Comment