Monday, September 30, 2013

নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?


শুকনো মুখ করে ছেলেটি হাঁটছে। মধ্যাহ্নের কড়া রোদের আলোয় তার পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী ঝলমল করছে। রিকশা-গাড়ী নেই বললেই চলে। পিচগলা রোদ উঠেছে বলেই কি অন্যদিনের চেয়ে আজ রাস্তা একটু বেশী ফাঁকা ফাঁকা লাগছে? নাকি অন্য কোন গোপন কারন আছে? তার চোখ লাল। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। রোদের দিকে তাকাতে পারছে না। তাকানো মাত্রই চোখ কটকট করছে।
তার খালাতো ভাই অন্তিকের পিঠে গাঢ় লাল রঙের একটা ড্র-স্ট্রিং ব্যাগপ্যাক। সে নিয়মিত বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের নাশতা করে। আজহিমু রোগে ধরা তার ভাইয়ের ধাক্কাধাক্কির কারনে দুপুরের দিকেই ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। এই নিয়ে সে বেশ খানিকটা হতাশ। সে হাঁটছেও হনহন করেট্রেন মিস হয়ে যাচ্ছেভঙ্গিতে।
মগবাজারের একটা গলির মুখের চায়ের দোকানে এসে সে থামল। পাংশুমুখে পাঁচ টাকা বের করে সিগারেট কিনল। এতোকিছুর বদলে শালার সিগারেটের দামটাই কেন বাড়ছে? বেনসনের দামে এক-একটা গোল্ড লীফ খেতে হচ্ছে। প্রেস ক্লাবের সামনে প্রায়ই দেখা যায় কিছু মানুষ সাইনবোর্ড হাতে মানব-বন্ধন, গণ-অনশন, সংবাদ সম্মেলন করছে। এদের মধ্যে কেউ কি সিগারেট খায় না? অথচ এই নিয়ে কাউকে একটা কথাও বলতে শোনা যায় না। তামাক-জাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে হচ্ছেটা কি? আগে ড্রাগসের টাকা জোগাতে ছিনতাই হত, এখন সিগারেটের টাকা জোগাতে ছিনতাই শুরু হবে। পাঁচ বছর পরে দেখা যাবে ঘরে ঘরে ছিনতাইকারীরা দুর্গ বানিয়ে বসে আছে।
চায়ের দোকানের সামনেই এক রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে তার কোন তাড়াহুড়া নেই। সে উদাস ভঙ্গিতে রমজান মাসেও মানুষজনের ভীড় করে চা-খাওয়া দেখছে। অন্তিক তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘শহীদ মিনার যাবা?’
রিকশাওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে রিকশার ওপর চড়ে বসল। যেন এতক্ষন তাদের অপেক্ষায়ই বসে ছিল। অন্তিক ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে হিমুরা কি রিকশায় চড়ে?’
হুঁ।হিমুর রূপালী রাত্রিতে চড়েছিল।
তাহলে আর সমস্যা কি? উঠে পড়্
রিকশা চলতে শুরু করল। অন্তিক হুড তুলে দিয়ে কায়দা করে একটা সিগারেট ধরালো। বাঙ্গালী বড়ই অদ্ভুত জাত। এরা রোজার দিনে বে-রোজদারকে সিগারেট ধরাতে দেখলে ভুড়ু কুঁচকে তাকায়। অন্তিক খেয়াল করে দেখেছে, যারা এই ভঙ্গীতে তাকায় তাদের বেশীরভাগই ইফতারের পরপর রাস্তায় নেমে চিপায় চাপায় ঢুকে টুপি পকেটে ভরে সিগারেট ধরায়। অন্তিক তার ভাইয়ের দিকে আধ-খাওয়া সিগারেটটা বাড়িয়ে দিল। হলুদ পাঞ্জাবীতে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে মাথা নাড়তে নাড়তে সিগারেট ফিরিয়ে দিল, ‘আমি রোজা।
হিমুরা কি রোজা রাখে?’
জানি না।
সে ভাবতে লাগলো, হিমুদের জীবন-যাপন পদ্ধতির কোন ধরা-বাঁধা নিয়ম কি সত্যিই আছে? এইসব আইনের কোনহিমুগ্রন্থঅবশ্যি নেই। হিমুরা যে সবসময় গায়ে হলুদ পাঞ্জাবী চড়িয়ে রাখবে-তাও না। আবার সবসময় খালি পায়ে হাঁটতেও তারা বাধ্য না।ময়ূরাক্ষীতে এমন হিমুর বিবরণ আছে। তবে প্রত্যেক হিমুই আলাদা- আবার সব হিমুরাই এক। একটি বিষয় সব হিমুদের জন্যে হয়ত সত্য। হিমুরা কখনো কোন নিয়মের আওতায় আসে না। নিয়ম-শৃঙ্খলা তাদের জন্য নয়। সেই হিসেবে আজ সে হিমু। অবশ্যই হিমু।
পরীবাগের মোড়ে রিকশা আটকে দিল। তারা হেঁটে হেঁটে শাহবাগের দিকে এগুচ্ছে। গা-ঝলসানো রোদটা হঠাৎ করেই কমে এলো। এর মধ্যেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো। চমৎকার একটা দিন! এই মেঘ। এই রৌদ্র। এই ছায়া। সে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটছে। আশেপাশের কিছু লোক তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কেউ-কেউ আবারহিমু ব্যপারটা ধরতে পেরে হাসাহাসি করছে। করুক হাসাহাসি। আজ সে হিমু। হিমুরা কখনও অবজ্ঞা-বিদ্রূপ গায়ে মাখে না।
তারা যখন টিএসসি মোড়ে এসে পড়েছে, তখন খেয়াল করল তরুন-তরুনীর বিশাল এক লাইন। সেই লাইনও আবার এক দিক থেকে না। নদী-উপনদী টাইপ। কয়েক দিক থেকে গিয়ে এক জনসমুদ্রে মিলিত হয়েছে। তার মধ্যে যেমন কিছু বৃদ্ধ ঢুকে পড়েছে। তেমনি ঢুকে পড়েছে কিছু শিশু। কিছু কিশোর। তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। লাইনে দাঁড়ানোর একটা মজার এফেক্ট আছে। অনেক আনন্দ নিয়েও যদি কেউ কোন লাইনে দাঁড়ায় তাহলে তার মধ্যে প্রথম শুরু হবে অস্বস্তি- তারপর বিরক্তি এবং ধৈর্যচ্যুতির সর্বশেষ পর্যায়ে দমবন্ধ-দমবন্ধ ভাব। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই লজিক এখানে কাজ করছে না। এরা সব শক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কারো কোন তাড়া নেই। বিরক্তি নেই। সবার হাতেই ফুল। বেশীরভাগের হাতেই কদম ফুল। তারা সবাই গম্ভীরমুখে ফুল হাতে এক-পা দু-পা করে লাইনের সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। লাইনের উৎপত্তি শহীদ মিনার প্রাঙ্গন।
হিমু তার ভেজা হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে সামনের দিকে হেঁটে গেলো। শহীদ মিনারের মঞ্চে কেউ একজন মাইকে প্রবল ভাবে চেঁচাচ্ছেন, “আমাদের প্রিয় লেখক আজ নেই। আপনারা ধীরে-ধীরে আসুন লাইন ভাঙবেন না। ... (খেঁকিয়ে) এই ছেলে এই... সরে দাঁড়ান, সরুন, সরে যান বলছি। হ্যাঁ আপনি আসেন। ... আমাদের প্রিয় লেখক আজ...” হিমু ভীড় ঠেলে যতই এগোচ্ছে সামনে ভীড় ততই প্রকট হচ্ছে। পুলিশ বেরিকেড দিয়ে রেখেছে। সবার দৃষ্টি সামনের দিকে। এদের কেউ কেউ মিসির আলী, কেউ শুভ্র, কেউ রূপা, কেউবা আবার তার মতই হিমু- গায়ে চড়ানো সেই বিখ্যাত হলুদ পাঞ্জাবী! সবাই তার প্রিয় লেখককে দেখতে চান। ভীড়ের ধাক্কায় হিমু আর অন্তিক পাশের এক চিলতে মাজারের আঙিনায় পৌঁছে গেল। মাজারের ফটকে লেখা বাবা তেলশাহ () এর মাজার। ততক্ষনে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। এই রোদ আরও গাঢ় হবে। কেউ টের পাবে না তাদের চোখে জল নেমেছে। সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে।
হঠাৎ করেই হিমু হতে চাওয়া ছেলেটার মনে হল, মানুষের জীবন এতো ছোট কেন? Ocean Quahog টাইপের ঝিনুকগুলার মত ফালতু জীব ৪০০ বছর বেঁচে থাকবে আর মানুষ ১০০ বছর যেতে না যেতেই মৃত্যুর প্রহর গুনবে- এটা কি রকম কথা? বৃষ্টি থামতে না থামতেই যে আকাশ ভর্তি হয়ে গেছে সূর্যের আলোয়, অদ্ভুত কোন কারনে সে আকাশটাকে মনে হচ্ছে স্বচ্ছ কাচের কোন আয়না। যে আয়নার কোমল রং ধরা যায় না। এতো চমৎকার একটা দিন হুমায়ূন আহমেদ দেখবে না। কোন মানে হয়? তারপর মনে হল একটা সময় আমরা কেউ থাকব না। কিন্তু তিনি থাকবেন, তাঁর সৃষ্টি থাকবে। তাঁর ভক্তদের চোখ দিয়ে তিনি পৃথিবী দেখতে থাকবেন অনন্তকাল। অমর মানুষের কি মৃত্যু আছে নাকি?? সবাই মিথ্যে বলছে। সবাই...
আমাদের হিমুটি জানে লাশ দেখলে সে থাকতে পারবে না। বোকার মত কান্না শুরু করবে। হিমু দুহাত দিয়ে তার মুখ খামচে ধরল। সে কাঁদবে না। হিমুরা কি কখনও কাঁদে?
অন্তিক পিছন দিক থেকে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল, ঐদিক থেকে গিয়ে দেখে আসি!
সে ক্ষীণস্বরে বলল, ‘না, থাক। চল। চলে যাই।
চল তাহলে। এম্নিতেও এই ভীড় ঠেলে ঢুকতেই খবর হয়ে যাবে।
সে কিছুই বলল না। প্রানপনে চোখের জল আটকে রাখতে সে ব্যস্ত। তার গায়ে হলুদ পাঞ্জাবী। কিন্তু এখন সে আর হিমু না। হিমুরা কাঁদে না। অথচ তার চোখ ভিজে যাচ্ছে। পৃথিবীতে মানুষের দুবার জন্ম হয়। প্রথম, যখন সে প্রথমবারের মত পৃথিবীটাকে দেখে তখন। আর দ্বিতীয়, যখন সে প্রথমবারের মত নিজেকে নিজে আবিষ্কার করতে পারে। তাকে এই মানুষটিনিজেকে আবিষ্কারকরতে শিখিয়েছে। জ্যোৎস্না দেখতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে বৃষ্টিতে ভিজতে- শিখিয়েছে খারাপ মুহূর্তে কি করে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। শিখিয়েছে মানুষ চাইলে সবকিছু পারে। এই মানুষটি তাকে নতুন করে জন্ম দিয়েছে। আজ এই মানুষটার জন্য যদি তার হিমুত্ব চলে যায়- যাক্‌! ছেলের দাবী নিয়ে সে চিৎকার করে কাঁদতেই থাকবে। কাঁদতে কাঁদতে বলবে, “সবাই মিথ্যে বলছে। সবাই... ”

মৃত্যুতে খুব বেশি দুঃখিত হবার কিছু নেই। প্রতিটি জীবিত প্রানীকেইএকটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মরতে হবে। তবে মৃত্যু মানে পুরোপুরি ধ্বংস নয়। মানুষের শরীরে অযুত, কোটি, নিযুত ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেলস যেমন-ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন- এদের কোন বিনাশ নেই। এরা থেকেই যাবে। ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। কাজেই মানুষের মৃত্যুতে খুব বেশি কষ্ট পাবার কিছু নেই। ( - হুমায়ূন আহমেদ)