ফুটবল বাদেও ফ্রান্সের জাদুঘর আছে, জার্মান গাড়ি আছে, ইতালির ফ্যাশন জগৎ আছে, ব্রাজিলের কফি আছে... কিন্তু আর্জেন্টিনার যে গোটা জগৎটাই ফুটবলময়! ফিফার তথ্য অনুযায়ী, আর্জেন্টিনায় নিবন্ধিত ফুটবলারের সংখ্যাই সাড়ে তিন লাখের কাছাকাছি আর সব মিলিয়ে প্রায় ২৬ লাখের মতো ফুটবলার এবং পৌনে চার হাজার ক্লাব! আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই কোনো না কোনো ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে জড়িত।
এই উন্মাদনা এক দিনে অবশ্য তৈরি হয়নি। আর্জেন্টিনায় রেললাইন স্থাপনের জন্য আসা ব্রিটিশ নাগরিকরাই স্থানীয়দের চিনিয়েছিল ফুটবল নামের এই অসাধারণ বিনোদনের সঙ্গে। অবাক করা তথ্য এই যে, আর্জেন্টিনার ইতিহাসে প্রথম ফুটবল ম্যাচটি হয়েছিল বুয়েনস এইরেস ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে! ১৮৯১ সালেই আর্জেন্টিনায় শুরু হয়েছিল ফুটবল লিগ, গ্রেট ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসের পরেই। সেই হিসাবে বলা যায়, গোটা লাতিন আমেরিকাতেই ফুটবলের তীর্থভূমি আর্জেন্টিনাই।
খেলা হিসেবে ফুটবল যত জনপ্রিয় হয়েছে, ততই জনমনে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এবং একই সঙ্গে অর্থনীতিতেও। ১৯৩০ সালে, বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসরেই রানার্সআপ হয়েছিল আর্জেন্টিনা, যদিও আর্জেন্টাইনদের
এখনো বিশ্বাস প্রথম আসরেই শিরোপা আসতে তাদের হাতেই। ব্রাজিলের চাইতে আয়তনে ছোট হলেও ইউরোপিয়ান লিগে ফুটবলার জোগাতে পিছিয়ে নেই আর্জেন্টিনাও। সেই ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালের পরই জুভেন্টাসে খেলতে ইতালি পাড়ি জমিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা দলের সেরা খেলোয়াড় লুই মন্টি, ১৯৩৪ সালে পরের বিশ্বকাপেই তিনি খেলেন ইতালির হয়ে। কারণ তত দিনে যে ইতালির নাগরিকত্বও নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি! ব্রাজিল বৃহত্তম দেশ হলেও ঔপনিবেশিক কারণে ভাষাটা পর্তুগিজ, অন্যদিকে আর্জেন্টিনার ভাষা স্প্যানিশ এবং ইতালীয়দের অভিবাসনের কারণে স্পেন ও ইতালির সঙ্গেও একটা সম্পর্কের যোগসূত্র তৈরি ছিল আর্জেন্টাইনদের।
যে কারণে এই দুই দেশের ফুটবল লিগে খেলতে গেছেন অনেক খেলোয়াড়, এখান থেকেই ইউরোপে খেলোয়াড়দের পাড়ি জমানোর শুরু। আলফ্রেদো দি স্তেফানো এবং ওমর সিভোরি- এই দুজনের নাম আসে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে। আলফ্রেদো দি স্তেফানোকে দলে নেওয়ার জন্য রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার কাড়াকাড়ির শেষে রিয়ালেই গিয়েছিলেন কদিন আগেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে চলে যাওয়া 'সোনালি তীর'। দি স্তেফানো পরে খেলেছেন কলম্বিয়া ও স্পেনের হয়েও। রিয়াল মাদ্রিদকে ইউরোপিয়ান কাপের প্রথম পাঁচ আসরেই শিরোপা জেতানো দি স্তেফানোকেই বিশ্বের সেরা ফুটবলার মনে করেন, এমন মানুষের সংখ্যা অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও খুব একটা কম নয়। ওমার সিভারি ইতালিয়ান নাগরিকত্ব নেওয়ায় তিনি বিবেচিত হয়েছিলেন ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারের জন্যও, যা তিনি পেয়েছিলেন ১৯৬১ সালে। যদিও তার অনেক পরেই দৃশ্যপটে ম্যারাডোনার আগমন, কিন্তু নাপোলিতে খেলা এবং খেলার কৌশলগত সাদৃশ্যের কারণে অনেকেই তাঁকে বলেন ষাটের দশকের ম্যারাডোনা।
আশির দশকটা মাতিয়ে রেখেছিলেন পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির এক বেঁটেখাটো ভদ্রলোক। তাঁর কল্যাণেই বুয়েনস এইরেস থেকে বহু দূরে, বাংলাদেশ নামের এই পাললিক বদ্বীপে চোখের জল ফেলে অনেকে, মেতে ওঠে উচ্ছ্বাসে। তাঁর কারণেই বিশ্বকাপ নামের এক মায়াবী জাদুতে চার বছর পর পর মেতে ওঠার উন্মাদনা, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মাঝে আর্জেন্টিনার সঙ্গেই যেন আত্মার বন্ধন, সে তো ম্যারাডোনার জন্যই। বিবিসির জরিপ বা পরিসংখ্যানের অঙ্ক, অনেক জায়গায় হয়তো পেলে শীর্ষে, ম্যারাডোনা দ্বিতীয়। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল দর্শকদের কাছে ম্যারাডোনা ফুটবল রোমান্টিকতার চূড়ান্ত মানবীয় রূপ আর তাঁর দেশ আর্জেন্টিনা।
এভাবে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর গহিন এবং দুর্গমতম কোনো প্রান্তে যদি একজন ফুটবলারের নামও পৌঁছায় সেটা হবে ম্যারাডোনা। এবার ম্যারাডোনা নেই, তাঁরই অবিকল প্রতিচ্ছবি হয়ে এসেছেন লিওনেল মেসি নামের এক খুদে জাদুকর। সেই একই জাদু, অবিকল সেই ইন্দ্রজাল এবং এবার তিনি শিরোপার মঞ্চে। প্রতিপক্ষ সেই জার্মানি, ১৯৮৬-তে ম্যারাডোনা রূপকথা পূর্ণতা পেয়েছিল জার্মানদের বিপক্ষেই।
মহান বিল্পবী চে গুয়েভারা জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনায়।
সাহিত্যে 'জাদুবাস্তবতা' নামের যে চমক, তার পথিকৃৎ হোর্হে লুই বোর্হেস ছিলেন আর্জেন্টিনার
নাগরিক। লাতিন সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী লেখিকা ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোও জন্মেছেন আর্জেন্টিনায়। এমনকি বর্তমান পোপও আর্জেন্টাইন কিন্তু সব ছাপিয়ে বিশ্বে সর্বজনীনভাবে আর্জেন্টিনা আসলে ফুটবলাদের দেশ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের জন্মভূমি।
No comments:
Post a Comment