পাশের বাড়ি থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে । থেমে থেমে মেয়েলী গলার কান্না । আমি মশারীর ভেতর থেকে খোলা জানালার কাছটায় একবার উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলাম । চারপাশে গাঢ় জমাট অন্ধকার । লোডশেডিং ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুরো এলাকায় । আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় না । প্রচন্ড গরমে আমার গা ঘেমে নেয়ে গেছে । জানালা দিয়ে গরম ভাপ আসছে । মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে, ঝড় আসবে বোধহয় । আমি ডাকলাম, ‘নীপু ! এই নীপু !’ । নীপু ঘুমের মধ্যেই আধো-আধো গলায় বলল, ‘এইতো !’ রাত দুটো-কি তিনটে বাজে । এত রাতে মেয়েটাকে জাগিয়ে তোলা ঠিক হবে না । মধ্যরাতের ঘুম একবার কেটে গেলে সহসা আর ঘুম আসে না । ঘুম না আসা প্রহর বড় বিরক্তিকর ।
আমি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে হাতপাখাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম । মাথার কাছেই ছিল পাখাটা । এখন কোথাও নেই । এত গরম, মশারির ভেতর বসে থাকা যাচ্ছে না । তাছাড়া বড্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে । আমি নীপুকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে খাটের এপাশে চলে এলাম । যদিও সাবধানতার বিশেষ প্রয়োজন নেই । নীপুর ঘুম খুব কড়া । কি রকম এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে মেয়েটা । শাড়ি সরে গেছে বুকের ওপর থেকে । অন্ধকারেও ওর ধবধবে ফরসা দেহ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । আমি ওর শাড়ি ঠিক করে দিয়ে আস্তে আস্তে মশারি থেকে বেরিয়ে এলাম । মশারি গুঁজে দিচ্ছি এমন সময় আবার কান্নার আওয়াজ এল । এবারেরটা তীক্ষ্ণ, খুব স্পষ্ট । কে কাঁদছে এত রাতে ?
আমি একটা শার্ট কোনরকম গায়ে চড়িয়ে দোতলার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে হাতরে হাতরে নিচে নামতে লাগলাম । নিঝুম নিস্তব্ধতায় কাঠের তক্তার ওপর আলতো করে পা রাখলেও ক্রূঢ় শব্দ হচ্ছে । শব্দ বাঁচিয়ে নামতে পারছি না বলেও নিজেকে অপরাধী মনে হয় । তাছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বাবার ঘর । আমি নামছি বুঝতে পারলে তিনি ডাক দেবেন, ‘অঞ্জন ! একটু শুনে যা তো বাবা ।’ অপ্রয়োজনীয় অর্থহীন কথাবার্তা হবে দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ । প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়ার পরে বাবা কথাও একটু বেশী বলেন । সব কথার শেষটা ঘুরে-ফিরে আঞ্জুমানের প্রসঙ্গে গিয়ে থামে । বাবা মুখ করুণ করে বলেন, ‘আঞ্জুমানের
চিঠিটা পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়েছে বুঝলি । এখন তো আর আগের সেই তেজ নাই, সামর্থ্যও নাই । নইলে দেখতি জেলের ঘানি টানাতাম ইন্দুরের বাচ্চাগুলাকে । তুই একবার যাবি নাকি নরসিংদী ? গেলে ভাল হয় । তাছাড়া কাল রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখলাম ওকে নিয়ে । দেখি কি...’
বাবা খুঁটিনাটিসহ স্বপ্নের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে যেতে থাকবেন । আমার নিজেকে অসহায় বলে মনে হবে । স্বপ্নের কথা শুনতে ইদানীং একেবারেই ভাল লাগে না । বাবা কেন আমার অবস্থাটা কিছুতেই বুঝতে চেষ্টা করেন না ? কেন নিতান্তই অবুঝ শিশুদের মত আচরন করতে থাকেন ? আমার প্রতিটি উত্তরে তার চেহারায় বিষণ্নতা নামে, গাঢ় অভিমান ঝরে পড়ে । তিনি বুঝতে পারেন না আমি একজন পরাজিত মানুষ । ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও বড়বোনের চরম দুঃখকষ্টে তার পাশে দাঁড়ানোর মত ক্ষমতা আমার নেই । তাকে নিজের কাছে এনে রাখার সাহস দেখানোর মত দুঃসাহসও আমার নেই । তাকে আনা মানে তার ন’দশ বছরের বাচ্চা ছেলে দুটির দায়িত্বও কাঁধে চাপিয়ে নেয়া, দুলাভাইয়ের মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির বিরূদ্ধে বড়পা যে মামলাগুলি করেছিলেন সেগুলির ভার মাথায় তুলে নেয়া । ছ’জনের এই ছন্নছাড়া সংসারটিকে মাসের ত্রিশ তারিখ পর্যন্ত কোনরকম করে টেনে নিয়ে যেতেই আমাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় । আমি চাইলেই নতুন করে আরও একটি সমস্যাকে আপন করে নিতে পারি না । এই ক্ষুদ্র বিষয়টি নিয়ে অভিমান করা তো বাবার সাজে না । নিজের বাবার কাছ থেকে আমার প্রতি এতটুকু সহানুভূতি তো আমি আশা করতেই পারি ।
আমি নিজের জীবনের প্রতি ক্রমেই নিরাসক্ত হই । এই সংসারের প্রত্যেকটি মানুষের বীতশ্রদ্ধাবোধ-ক্ষোভ আমি তাদের চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই । অথচ আমি তো এই মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে এসেছি তাবৎ জীবন । কারো স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে নিজের স্বপ্নকে প্রাধান্য দিয়ে চলিনি । একটা সময় ছিল যখন অনেক বড়-বড় স্বপ্ন দেখতাম । স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্নের কথা শুনতে-বলতে বড় ভাল লাগতো । সেইসব স্বপ্নের অদৃশ্য পাখায় ভর করে আমার কত ওড়াওড়ি ! ভ্রম ভাঙার কষ্টটুকু নিতে শিখবার আগেই হুটহাট সেই পাখা ভেঙে গেল । কখন টেরও পাই নি ! কলেজ জীবনে তুহিন, মৃদুলরা যখন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যে কোচিং এ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, আমার বাবা তখন বললেন, ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে করবেটা কি ? দেশে কি এদের অভাব পড়েছে ? তাছাড়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের
বেশীরভাগই এখন বেকার হয়ে ঘরে বসে আছে ।’
বাবা এসব বলতে বলতেই আগের সপ্তাহের বাসি পত্রিকা ঘাঁটতে থাকতেন যেগুলোর কোন একটির প্রথম পেজে ফলাও করে বেড়িয়েছিলঃ ‘চিকিৎসক-প্রকৌশলীরাই বেশী বেকার’ । মা হয়ত একটু আপত্তির সুর তুলতেন । বাবা হাত নেড়ে বলতেন, ‘এই দ্যাখো, দ্যাখো পরিসংখ্যান কি বলে... বিবিএস এর দেয়া তথ্য অনুসারে বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক প্রকৌশলীদের হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ... স্নাতক ডিগ্রীধারীরা বেশী চাকরি পান... । দেশে অভাব সৎ মানুষের... ডাক্তার-ফাক্তার ওসব রদ্দি হয়ে গেছে । দরকার হলে পাশ করে বিসিএস দেবে ... । ওয়ান-টু’র মধ্যে চাকরী হয়ে যাবে । বিসিএস-এ না হলেও আমার চেনাজানা লোক আছে । ঐ যে শরাফ সাহেবের কথা বললাম না একদিন... ।’
বাবা একাই বলে যেতেন । আমিও ভেবে নিতাম আমি কোচিং না করলে যদি বড়’পার বিয়েতে জমকালো একটা অনুষ্ঠান হয়, ক্ষতি কি ? কতদিন এমন হয়েছে আমার টিউটোরিয়াল পরীক্ষার আগের রাতে নানাবাড়ি থেকে দুঃসম্পর্কের কয়েকজন আত্মীয় এসেছেন । মা আমার ঘরে এসে মুখ কালো করে বলেছেন, ‘আজ রাতে আলো জ্বেলে না পড়লে হয় না ? উনারা তোর ঘরে ঘুমুক । এক রাতেরই তো ব্যাপার !’ ওরাও নিশ্চয়ই ঢাকায় এসেছিল নিজস্ব কিছু স্বপ্ন নিয়ে । আমি অল্পপরিচিত কিছু মানুষের স্বপ্নেরও মূল্য দিয়েছি । বাতি নিভিয়ে ভেবেছি একটা টিউটোরিয়াল-ই তো ! এমন কত-কত টিউটোরিয়ালের আগের সমস্ত রাত বাতি নিভিয়ে কেটেছে আমার, দুঃশ্চিন্তায়... এপাশ-ওপাশ, এপাশ-ওপাশ,... এখন মাঝে মাঝে মনে হয় কারো স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে নিজের স্বপ্নকে প্রাধান্য দিতে শিখলাম না কেন ? ঐটির প্রয়োজনই তো ছিল বেশী ।
আর এখন ? তুহিন-মৃদুলদের দেখলেও মুখ লুকানোর চেষ্টা করি । ওদের সুর করে ‘মাস্টারসাহেব’ ডাকটা এখনও সহজভাবে নিতে শিখতে পারি নি যতটা সহজে সবাইকে ‘হ্যাঁ’ বলতে শিখে গিয়েছিলাম আপনাতেই । এখনও কাউকে সরাসরি ‘না’ শব্দটি বলতে বুকে বাঁধে । সবাই কি সবটা পারে ? আমার সব স্বপ্নভঙ্গের দিন পার করার পরেও এইখানে দুঃস্বপ্নের প্রহরে এসে দেখি, অন্যদের সমস্ত স্বপ্ন এখনও ক্ষুধার্ত বাঘের মত এসে পর্যায়ক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার পাখা ভাঙা কাঁধে ! আমি ‘না’ বলতে পারি না বলেই নিয়ে নিই । আমার ক্লান্ত চোখ এত এত স্বপ্নের বোঝা নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজে চলে । তারপরও কোন ব্যাপারেই সবার খুশীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না । কারও মন-ই রক্ষা হয় না । নিজেকেই কখনো কখনো আমার এ সংসারে বাড়তি ঝামেলা বলে মনে হয় । কোন কোন দিন রাতে বাড়ি ফিরে নীপু নামের বাইরের একটি মেয়েকে ভাত নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে খাবার টেবিলে ঘুমিয়ে পড়তে দেখি । সেই স্নেহটুকুও আমার মন খারাপ করিয়ে দেয় । কেবলই মনে হয়, ‘এই মেয়েটিকে আমার জীবনের ছড়িয়ে থাকা অন্তহীন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত করাটা কি খুব বেশী প্রয়োজন ছিল ?’ বারবার মনে হয়, ‘নীপুর মত চমৎকার একটি মেয়ের জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম’ । হতাশা আর হতাশা । হতাশার গভীর চোরাবালি আমায় গ্রাস করে নিতে চায় । সেখানে প্রতিদিন বাবার কাছ থেকে বড়পা’কে এখানে নিয়ে আসার সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত পেয়ে আমার বেঁচে থাকাটাকে আরও ঘেন্নাকর মনে হয় ।
আমি কোন রকম পা টিপে টিপেই নীচতলায় নেমে এলাম । বাবা তাও শুনতে পেলেন । তিনি আবেগ নিয়ে ডাকলেন, ‘বাবা অঞ্জন ! ভিতরে আয় তো একটু ।’ আমি বাবার আবেগকে প্রশ্রয় দিলাম না । বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । খাবার ঘরে ঢুকতে যাবো, খুনসুটির শব্দ পেলাম । কেউ একজন খিলখিল করে চাপা ভঙ্গিতে হাসছে । লীনা আর স্বর্ণা খাবার ঘরের পাশের খাটটিতে শোয় । এরা এত রাত জেগে করছে কি ? আমি কান না পেতেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওদের দুজনার কেউ একজন বলছে, ‘কালকেই
না দেখা করলে ? প্রতিদিন দেখা করতে হবে নাকি ?---দূর অসভ্য !’
আমি ক্ষীণস্বরে ডাকলাম, ‘লীনা !’, সঙ্গে সঙ্গে সব কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল । চারপাশের নীরবতা সেলফোনের ওপাশের কণ্ঠটাকে আরও তীক্ষ্ণতর করে তুলল । কেউ একজন জান্তব স্বরে বলছে, ‘এই ! কথা বলছো না কেন ? কি হয়েছে ? কথা বলছো না কেন ? রাগ করো না সোনা...’ সেলফোনের বাতিও জ্বলে উঠল এই সময় । আমি আবারও ডাকলাম, ‘লীনা ! স্বর্ণা
!’ এবারও দুজনের কেউ জবাব দিল না । বড়ভাই হিসেবে আমার ঠিক কি করা উচিত আমি বুঝে উঠতে পারি না । ক্লান্ত ভঙ্গিতে প্লাস্টিকের জগ হাতে নিয়ে সামনের ঘরে চলে আসি । এই ঘরটায় সোফার ওপর বাবলু ঘুমায় । নীপুকে বিয়ে করার আগে সে আমার সাথে দোতলার ঘরটাতে ঘুমাতো । তার বোবায় ধরা রোগ আছে । কোন কোন রাতে সে প্রবলভাবে খাট কাঁপিয়ে ছটফট করতো । তার সারা গা দরদর করে ঘামতো । তার গায়ে হাত দিতেই সে উঠে বসে বলতো, ‘দাদা, পানি খাবো !’ সে কি এখনো গভীর রাতে ভয় পেয়ে জেগে ওঠে ? আমি জানি না । তাকে কেন যেন জিজ্ঞেস করাও হয় না । প্রায়ই ভাবি বলবো, ‘একা একা ঘুমাতে ভয় লাগে নাকি রে বাবলু ?’ বলা হয় না । বাবলুর জন্য সেই কবে থেকে একটা খাট কিনবো বলে ভেবেছি, কেনা হয়ে ওঠে নি । আজ এক বছর ধরে সে সোফায় ঘুমুচ্ছে । তার কোন অনুযোগও নেই । যেন সোফায় ঘুমুতে পেরেই সে খুশী । এসব ভাবতে গেলেই নিজের প্রতি আঙুল ওঠাতে হয় । আমার কিছুই ভাবতে ভাল লাগে না । তবু, কি করে জমানো টাকাগুলো কর্পূরের মত নিঃশব্দে উড়ে যায়, মনের ভেতর কেবল তাই ফিসফাস করে ।
গত মাসে মেজো খালার বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান গেল । একবার ভেবেছিলাম যাবো না । যাওয়া মানেই তো আবার বাড়তি খরচা । নীপু খুব করে ধরলো আমাকে, ‘লীনা-স্বর্ণার মন ভেঙে যাবে । ওদের কোথাও যাওয়া হয় না । তাছাড়া সামাজিকতা বলে তো একটা কথা আছে । ইত্যাদি ইত্যাদি... ।’ তার অনুনয়ের সামনে আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না । যা ভেবেছিলাম তার দ্বিগুন খরচ হল । তারপরও মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে মেজোখালু কথাপ্রসঙ্গে বললেন, ‘অনুষ্ঠানে হাত খুলে খরচ করেছিলাম এই ভেবে যে বিয়ের দায়দায়িত্ব না নিলেও আত্মীয়স্বজনরা দোয়াটুকু অন্ততঃ ঠিকমত করে দেবে । শখ করে কার্ড ছাপিয়েছি । পুরান ঢাকা থেকে হাশমত বাবুর্চিকে ম্যানেজ করে আনিয়েছি । আর মোট টাকা কত উঠেছে, শুনবা ? দশ হাজার । এমন ফকিরনী গুষ্ঠী, খাম ধরিয়ে গেছে সুমো কুস্তিগীরের মত ইয়া বড় সাইজ । ভেতরে পঞ্চাশ টাকার ছয়টা নোট । তার একটা আবার কোণার দিক থেকে ছিঁড়া ।’
আমি আর বৌভাতে গেলাম না । বাবলু-লীনা-স্বর্ণাকে ফেলে রেখেই চলে এলাম । নীপু আসার সময় বারবার করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হলো তোমার ? কি এমন কাজ ? বললে না সব গুছিয়ে রেখে এসেছো ?’
আমি বলতে গিয়েও পারি না । কথাগুলো গলায় আটকে থাকে । ইতস্ততঃ করে বলি, ‘খুব জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে নীপু । না গেলেই নয় । তুমি বরং থেকে যাও ।’
নীপু শক্ত গলায় বলল, ‘না । তুমি ছাড়া আমি থাকবো না । স্বর্ণা-লীনাকে কে নিয়ে যাবে পরে ?’
‘আমিই না হয় দুদিন পরে এসে নিয়ে যাবো ।’
নীপু শক্ত গলায় বলল, ‘না । তুমি ছাড়া আমি থাকবো না । স্বর্ণা-লীনাকে কে নিয়ে যাবে পরে ?’
‘আমিই না হয় দুদিন পরে এসে নিয়ে যাবো ।’
নীপু হয়তো ভেবেছিল আমাকে মানিয়ে নিতে পারবে । পরে কি চিন্তা করে তেমন গরজ করল না । চোখমুখ অন্ধকার করে বলল, ‘না গেলেই নয় ?’
‘আমার থাকলে কিছুতেই চলে না নীপু ।’
‘আমার থাকলে কিছুতেই চলে না নীপু ।’
আমি নিঃশব্দে সামনের দরোজার হুড়কো খুলতে যাবো, দেখি দরোজা হাট করে খোলা । বাইরে থেকে ঝিঁ-ঝিঁ পোকাদের অবিশ্রান্ত কোলাহল । যেন কেউ একজনের জন্মদিনের পার্টি করছে তারা । যেখানে কথা বলে যেতে কারও ক্লান্তি লাগে না, শুনেও ভেতর থেকে আনন্দ বোধ হয় । মনে হয়, ‘হোক না একটু শোরগোল । এমন উপলক্ষ্য আবার কবে কি আসবে ?’
আমি বাইরে বেরুতেই ঝন্ঝন্ করে কিসের শব্দ হল । তাকিয়ে দেখি বাবলু একা একা শক্ত হয়ে বারান্দার এক কোণাতে দাঁড়িয়ে আছে । তার পায়ের কাছে কম্পাস, চাঁদা, সেট স্কয়ার, রবার-কাঁটাদের ভীড়ে ছড়ানো দু-তিনতে বই খাতার ওপর একটি কাচের বয়ামের নীচের পাশ ভেঙে গুঁড়ি-গুঁড়ি হয়ে পড়ে আছে । বয়ামের ভেতর থেকে হাজারো জোনাকি পোকা উড়ে উড়ে বেরুচ্ছে । নিকষ অন্ধকারের মধ্যে তাদের অজস্র সবুজ টিমটিমে আলোতে পুরো বারান্দাটাকে অলৌকিক সুন্দর লাগছে । আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম । বহুদিন এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখা হয় না । শেষ মনে আছে নীলগিরির কথা । পাহাড়ে চড়তে চড়তে কত ফুট উঁচুতে উঠেছিলাম জানি না । তবে বুঝতে পারলাম আমি মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারছি । সবার সে কী চিৎকার ! নন্দিতা নাম করে একটি মেয়ে তো ছেলেমানুষীর চূড়ান্ত করলো । সে পাঁচ-ছয়টি মোটা মোটা খামে মেঘ জমা করতে শুরু করলো । আহ্লাদী করে বলল, ‘প্রিয় মানুষগুলোর জন্য খামবন্দী করে মেঘ নিয়ে যাচ্ছি’ । অন্য কেউ হলে আমরা হেসেই খুন হয়ে যেতাম । কিন্তু রূপবতী মেয়েদের আহ্লাদীপনাগুলো সম্ভবতঃ সব ছেলেরাই মার্জনার দৃষ্টিতে দেখে । আমার মনে আছে, ঐদিন আমারও মনে হয়েছিল আমিও খামে করে কিছু মেঘ ধরে নেই ! আমি পারি নি । সবাই কি সবটা পারে ?
সেই কবে ভার্সিটি থেকে হল্লা করে নীলগিরিতে গিয়েছিলাম । এখনও চোখে ভাসলেই মন ভরে ওঠে । কত সুখস্মৃতি । অথচ যাওয়াটা এক রকম অসম্ভবই ছিল । বাবা কিছুতেই যেতে দেবেন না । তিনি তখনও রিটায়ার করেন নি । যতক্ষণ বাসায় থাকতেন আমরা তার ভয়ে কাঁপতাম । কি করে যেন ‘নীলগিরি’র কথাটা বলে ফেলেছিলাম সাহস করে । তিনি রাগে গজগজ করতে করতে পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন, ‘ইন্দুরের বাচ্চার শখ হয়েছে । আকাশে উড়তে চায় । পেঁদিয়ে পাছার চামড়া লাল করে দিতে হয় এইসব পাখাগজানো ইন্দুরের ।’ ঐদিন মন খারাপ করে খুব কেঁদেছিলাম । এখন বুঝি ঐদিন হয়তো বাবাই ঠিক ছিলেন । শখ করে ঘুরে বেড়ানোর মত টাকা দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না । পুলিশে চাকরী করেও ‘ঘুষ’ শব্দটিকে তিনি প্রচন্ড ঘৃণার চোখে দেখতেন । সামর্থ্যটা তাই এখনকার মতই ছিল । পার্থক্যের কথা ধরতে গেলে সেদিন আমি অবুঝ ছিলাম, আজ সেই জায়গাটিতে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন । আসলে বোঝা না বোঝার গন্ডিটা খুব সূক্ষ্ণ । আমরা অনেক সময় বুঝেও না বোঝার অভিনয় করি । ভাবি, এইতো ! আর কিছুটা সময় ! সবকিছু
ঠিক হয়ে যাবে । খুব তাড়াতাড়িই ঠিক হয়ে যাবে । অথচ কিছুই ঠিক হয় না । কেবল এলোমেলো হতে থাকে । হতেই থাকে ।
বাবলু কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘দাদা, তুমি এত রাতে ?’
‘ঘুম ভেঙে গেল । তুই কি করছিস বাইরে একলা একলা ?’
‘উপপাদ্য লিখছিলাম । পরশু জমা ।’
‘তাই বলে এত রাত জেগে ?’
‘আমার জ্যামিতি বক্সটা হারিয়ে গেছে । শিপলুরটা ধার করেছি । ওকে কালকেই যে ফেরত দিতে হবে দাদা ।’
‘ঘুম ভেঙে গেল । তুই কি করছিস বাইরে একলা একলা ?’
‘উপপাদ্য লিখছিলাম । পরশু জমা ।’
‘তাই বলে এত রাত জেগে ?’
‘আমার জ্যামিতি বক্সটা হারিয়ে গেছে । শিপলুরটা ধার করেছি । ওকে কালকেই যে ফেরত দিতে হবে দাদা ।’
সে বোধহয় বয়ামভর্তি করে জোনাক পোকার হারিকেন বানিয়েছিল । আমি চমকে দেয়াতে যেটা ভেঙে গুঁড়িগুঁড়ি হয়েছে । আমি অধৈর্য্য হয়ে বললাম, ‘জ্যামিতি বক্স হারিয়েছে তো আমাকে বললেই হতো । আরেকটা কিনে আনতাম ।’ বাবলু নিঃশব্দে বইয়ের ওপর থেকে ভাঙা কাঁচের গুঁড়ি কুড়াচ্ছে । অন্ধকারে কাঁচের গুঁড়ো হাতে বিঁধে একটা রক্তারক্তি কান্ড না বাঁধালেই হয় । আমার বলা উচিত, ‘সাবধানে বাবলু ! হাত কাটবে ।’ আমার কিছুই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না । নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছে । বাচ্চা ছেলেটা অনুযোগ-অভিযোগ করা ছেড়ে দিয়েছে । হয়তো সে নিজে নিজে ভেবে নিয়েছে এসব করে লাভ নেই । হয়তো আমার মতই সে স্বপ্ন ভাঙার কায়দা কানুন একা একা শিখে চলেছে... আবার কান্নার শব্দে সচকিত হয়ে উঠলাম । মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল, ‘কাঁদে কে এত রাতে ?’
বাবলু বলল, ‘রূম্পা দি ।’
বাবলু বলল, ‘রূম্পা দি ।’
আমি অবাক হয়ে দেখলাম রূম্পাদের দোতলা বাসার ছাদের কিনারায় বসে রূম্পা কাঁদছে । এই মেয়েটিকে আমি কখনও কাঁদতে দেখি নি । সারাক্ষন হাসছে । আনন্দ করছে । খুব মজার ব্যাপার হল এই রূম্পার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল । আমি তখন নতুন নতুন নয়াপাড়ার প্রাইমারী স্কুলটাতে চাকরি নিয়েছি । মা তখন বেঁচে ছিলেন । প্রতিদিন ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলেন আমার বিয়ে দেবেন । রূম্পাকে তিনি পাত্রী হিসেবে খুঁজে বের করলেন । রূম্পা তখন খুব সম্ভব এসএসসি দিয়েছিল । রেজাল্টের অপেক্ষা করছে । আমি মাকে বললাম, ‘পাগল হয়েছেন ? এই মেয়েকে আমি নিতান্তই বাচ্চা দেখেছি, উঠোনে ছক কেটে এক্কাদোক্কা খেলছে কিংবা ‘বরফ-পানি’ বলে চিৎকার করতে করতে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে । একে কি বিয়ে করবো ?’
মা কোন কথাই শুনলেন না । পান-চিনি পর্যন্ত করিয়ে ফেললেন । বিয়ে হবে কার্তিক মাসে এমন স্থির হয়ে ছিল । ঐসময় রূম্পা খুব অদ্ভুত আচরণ করতো । ওদের বাড়ির ছাদে উঠে আমার ঘরে কখনো-সখনো কাগজ ছুঁড়ে মারতো । সেখানে কয়েকটা এলোমেলো বাক্য লেখা থাকতো হয়তোবা । কখনো আবার আমি জানালার ধারে, আমার দিকে তাকিয়েই সে বারান্দা থেকে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলতো, ‘মা নীচে গিয়ে খাতা কিনে নিয়ে আসি ?’ যাবো না, যাবো না ভেবেও কেন যেন আমি তাড়াহুড়ো করে চুল আঁচড়ে নিচের মুদির দোকানটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম । যেখানে খাতা কলমও বিক্রি হয় । গলা শুকিয়ে যেতো আমার । হাত ঘামতো খুব । রূম্পাকে দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত সুখের একটা অনুভূতি হতো । যেই মেয়েটিকে কখনো দেখেও নজর করে দেখিনি, তারই বৃত্তে আমার স্বপ্নগুলো নির্দ্বন্দ্বে ঘোরাফেরা করতে শুরু করল ।
সম্বন্ধটা ভেঙে গেল অকারণেই । বাবার সঙ্গে খুব চেঁচামেচি হল রূম্পার বাবা-মায়ের । এরপর মা মারা গেলেন । তার এত সাধের পুত্রবধূ দেখে যাওয়া আর হল না । এই নিয়ে কেউ খুব একটা কথা তুলল না । আমিও বলতে পারলাম না কিছু । পরের কার্তিক মাসের কোন এক সন্ধ্যায় নাসির ভাই’র সাথে বিয়ে হয়ে গেল ওর । পারিবারিক ধাঁচের বিয়ে । নাসির ভাই ওদের বাসার চিলেকোঠায় ভাড়া থাকতেন । চেনাজানা ছেলে । আমার এক কি দুই বছরের বড় হবেন । ঐদিন রাতে বুকের মাঝখানে কেমন একটা ব্যথা অনুভব করলাম । নাসির ভাইকে খুব বেশী হিংসা হতে লাগল আমার । শেষরাতের দিকে মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি, ‘আমি নাসির ভাইর চেয়ে কম কিসে ?’ জমাটবদ্ধ
কষ্ট কত কত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে- তার হিসেব কোথায় হারিয়ে গেছে !
সেই সদাহাস্যোজ্জ্বল রূম্পা এখন কাঁদছে । নাসির ভাইর সাথে ওর বিয়েটা না হওয়াই ভাল ছিল । নীপু একবার কি কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘নাসির ভাই রূম্পার গায়ে হাত তোলে ।’ আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । নীপু আরও অনেক কথাই বলে চলেছিল যেগুলি নিঃশব্দে আমার মনের ভেতর একটা ঝড় তুলল । আমি যদিও নীপুকে নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি । করা উচিতও নয় । আজ অনেক কিছু একসঙ্গে বুঝতে চেষ্টা করি, আমার কি রূম্পার জন্য খারাপ লাগে ? এখন কি খারাপ লাগছে ? আমি কি এখনও ওকে ঠিক আগের মত করে ভালবাসি ? নাকি নীপু সেই অভাব ভুলিয়ে দিয়েছে ? রূম্পা
মেয়েটা কি এখনো আমায় নিয়ে ভাবে ? সে কি কখনো আমায় ভালবেসেছিল, আমার মত করে ? মানুষের
ভালবাসা, ভাললাগাগুলি সময়ের সাথে সাথে কতটুকু বদলে যায় ? আদৌ কি বদলায় ? আমি বুঝতে চেষ্টা করি । কিছুতেই বোঝা না বোঝার সেই সূক্ষ্ণ গন্ডিটা অতিক্রম করতে পারি না !
বাবলু বইপত্র নিয়ে ঘরে নিঃশব্দে ঢুকে গেল । এখনও উঠোনভর্তি গাঢ় অন্ধকার । আমি বারান্দার ইজিচেয়ারটাতে পা মেলে বসে অন্ধকার দেখতে লাগলাম । আমার বাসর রাতের দিন এমন অন্ধকার ছিল । ঐদিন অবশ্যি ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল খুব । পাওয়ার স্টেশন থেকে এমন বিকট শব্দ এল, যেন বাজ পড়েছে । কে যেন মাথা নেড়ে বলল, ‘সারা রাতের মামলা’ । আমি বাসর ঘরে ঢুকে দেখি কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না । কি আশ্চর্য ! ঘরে কেউ হারিকেন বা মোমবাতি দিয়ে যাবে না ? আমি খাটে বসেই বিব্রত গলায় বললাম, ‘আপনি বসুন । আমি মোম জ্বেলে নিয়ে আসছি ।’
‘মোম দেয়াশলাই দিয়ে গেছে । আমি নিভিয়ে রেখেছি ।’
‘কি কথা ? কেন ?’
‘আমার অন্ধকারেই ভাল লাগছে । আপনার কি অন্ধকারে ভয় হয় নাকি ?’
‘না । ঠিক আছে ।’
‘আমার কিন্তু লোডশেডিং খুব প্রিয় !’
‘তাই বুঝি ?’
‘জ্বি । কেন প্রিয় জানতে চান ?’
‘বলুন ।’
‘পুর্নেন্দু পত্রীর একটা কবিতা পড়ার পর থেকে । বলুন তো কোন কবিতা ?’
‘আমি কবিতা খুব একটা পড়ি না । ইন্টারমিডিয়েটের বাংলা বইয়ের ‘কবর’ কবিতার পর আর কোন কবিতা পড়া হয় নি ।’
‘সে কী !’
‘মোম দেয়াশলাই দিয়ে গেছে । আমি নিভিয়ে রেখেছি ।’
‘কি কথা ? কেন ?’
‘আমার অন্ধকারেই ভাল লাগছে । আপনার কি অন্ধকারে ভয় হয় নাকি ?’
‘না । ঠিক আছে ।’
‘আমার কিন্তু লোডশেডিং খুব প্রিয় !’
‘তাই বুঝি ?’
‘জ্বি । কেন প্রিয় জানতে চান ?’
‘বলুন ।’
‘পুর্নেন্দু পত্রীর একটা কবিতা পড়ার পর থেকে । বলুন তো কোন কবিতা ?’
‘আমি কবিতা খুব একটা পড়ি না । ইন্টারমিডিয়েটের বাংলা বইয়ের ‘কবর’ কবিতার পর আর কোন কবিতা পড়া হয় নি ।’
‘সে কী !’
নীপু এমনভাবে ‘সে কী’ বলল যেন কবিতা না পড়া কোন দন্ডনীয় অপরাধ । আস্তে আস্তে বুঝলাম নীপুর অনেককিছুই আমার সঙ্গে মেলে না । তার শখ-আমার শখে বিস্তর ফারাক । সে বেড়াল পছন্দ করে । আমি বেড়াল দুচক্ষে দেখতে পারি না । সে চা খায় না । আমার সকালে-বিকেলে দুবেলা চা লাগে । আমি গরম একেবারেই সহ্য করতে পারি না আর নীপু কাঁথা ছাড়া ঘুমুতেই পারে না... । এমন কত খুঁটিনাটি পার্থক্য । তবু আমি নিঃসন্দেহে জানি যে আমরা ভাল আছি । ভাল থাকার সংজ্ঞা কি, আমি জানি না । তাছাড়া সবার ভাল থাকার সংজ্ঞা একও নয় ।
আমি যে রাতে জেগে জেগে গল্প করার প্ল্যান করি সেই রাতে সে ক্রমাগত হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘স্যরি । অনেক ঘুম পাচ্ছে ।’ আমি বলি, ‘আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো’ । সে ঘুমায় না । আমাকে খুশী রাখার জন্য অনেক রাত ঘুম-ঘুম ঘোর নিয়ে জেগে থাকে । আমাকে খুশী রাখার সবরকম চেষ্টা সে চালিয়ে যায় । আমি বুঝি না একটা মানুষ কিভাবে প্রত্যেকটা ব্যাপারে অন্য একটা মানুষের খুশীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে । আমি তো পারি না । নীপুর সঙ্গে দেখা না হলে আমি জানতেও পারতাম না, এমন মানুষও আছে । আমি সহসা বুঝতে পারি নীপু আমায় ভালবাসে ।
আমি কি নীপুকে ভালবাসি ?, নিজেকে প্রশ্ন করি আমি । কৌতূহল হয়- নিজের কাছে উত্তর সরাসরি দিতে সাহস পাই না খুব । প্রথম প্রথম নীপুকে বড় একটা ভাল লাগতো না কেন যেন ! সবসময়ই মনে রূম্পা নীপুর জায়গাতে থাকলে এখন কি করতো, কি জবাব দিতো ইত্যাদি । যেদিন গভীর রাত্রে সে খুব গাঢ় অন্ধকারে প্রথমবারের মত আমায় জড়িয়ে ধরেছিল, আমি চমকে গিয়েছিলাম । শারীরিক সম্পর্কটা ভালবাসাবাসির ক্ষেত্রে যতটা তুচ্ছ করে দেখা হয়, ততটা তুচ্ছ করবার মত এটা নয় বোধ হয় । বিজ্ঞানও তো তাই বলে । যখন আমরা হাত মেলাই, আলিঙ্গন করি- আমাদের শরীরের ইলেক্ট্রনগুলো
অদল-বদল হয় । নশ্বর পৃথিবীতে আমাদের ঐটুকুই তো অবিনশ্বর । সেইটুকু যখন মিশে যায়- মন মিশতে সময় লাগার কথা নয় । আমাদের দূরত্বটা এক ধাক্কায় কতটুকু কমে এল, নীপুকে আমি কবে সইতে শুরু করলাম, তার কথায় কবে থেকে ভরসা জন্মানো শুরু করলো আমার মনের মধ্যে সেই হিসেব জানা নেই বলেই হয়তো আমাদের সম্পর্কটা এত মসৃণ, এত ঋজু ! এই মসৃণতাকে কি সত্যিকারের ভালবাসা বলা যায় ?
‘এই ! কি করছো ?’
আমি তাকালাম । নীপু নীচে নেমে এসেছে । তার হাতে আধগলা শাদা একটা মোমবাতি । মোমের আলোয় তার মুখ আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে । কাজল লেপ্টে যাওয়া চোখে, না-আঁচড়ানো চুলেও কি দারূন লাগছে তাকে ! আমি নরম গলায় বললাম, ‘নীপু, তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে !’
নীপু ছেলেমানুষী একটা মুখভঙ্গি করল । আমি হাসলাম । সে মোড়া টেনে আমার পাশে বসল । আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, ‘আচ্ছা, তুমি কি মেজোখালার মেয়েকে গহনা বানিয়ে নেয়ার জন্য কোন টাকা দিয়ে এসেছিলে নাকি ?’ নীপু খুব অবাক হল । একটু ভেবে সে তার ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার জমানো টাকা থেকে দিয়েছিলাম । কেন বলতো ?’ আমি নির্বিকার কন্ঠে বললাম, ‘আমাকে বিয়ে করে তোমার কখনো অনুশোচনাবোধ হয়েছে নীপু ?’
‘বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে জানাতাম । সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাই... ।’
‘আমি সেকথা বলছি না নীপু । তোমার কি কখনো অনুশোচনাবোধ হয়েছে আমায় নিয়ে ?’
‘বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে জানাতাম । সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাই... ।’
‘আমি সেকথা বলছি না নীপু । তোমার কি কখনো অনুশোচনাবোধ হয়েছে আমায় নিয়ে ?’
নীপু উঠে দাঁড়িয়ে পরম মমতায় আমার কাঁধে হাত রাখল । তার গাল দিয়ে আমার মাথা চেপে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ । কোথা থেকে একটা লক্ষীপেঁচা ডেকে উঠল যেন ঐসময় । একটা দমকা বাতাস এসে ক্ষনিকের জন্য উঠানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো ঝাঁকড়া কাঁঠাল গাছটাকে দৃশ্যমান করে তুলল । বাতাসে দূরের কোন গাছ থেকে বাতাবিলেবুর গন্ধ নাকে এসে লাগছে । আমি দীর্ঘ করে নিঃশ্বাস নেই । মাঝে মাঝে নৈঃশব্দও বুঝি ভরসার গান হয়ে ওঠে ? শুনশান নীরবতাও ভালবাসা জানানোর মাধ্যম হয় ! এইতো, আমি নীপুর নরম গালের ধীরে ধীরে ভিজে ওঠা অনুভব করতে পারছি । খামবন্দী করে সে মেজোখালার মেয়েকে কিছু ভালবাসা দিয়ে এসেছে । আমি যা ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারতাম না । কিছু কিছু মানুষ হয়ত নিঃশর্ত ভালবাসা দেয়ার জন্যেই জন্মায় । নন্দিনীর মত এরা মেঘকেও খামে বন্দী করে ফেলতে পারে । সবাই কি এতোটা ভাগ্য নিয়ে জন্মায় ? এমন ভাগ্যবতী একটি মেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে অকারণে কাঁদছে কেন ? আমার কি উচিত না ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে ওকে চমৎকার করে গুছিয়ে কিছু কথা বলা ? ভালবাসার কথা ! আমি কিছুই বলতে পারলাম না । ওর কাঁধে মুখ লুকোনোর চেষ্টা করলাম; নীপুর মমতাময় আলিঙ্গনে আমারও যে ক্রমেই চোখ ভরে আসছে !
‘ভাল থাকা-না থাকা’র হিসেব করার চেয়ে এই ভাল । পরিচিত উঠান-বারান্দা-দোতলা বাড়ি । বাবার আক্ষেপ, চোখের সামনে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা স্বর্ণা-লীনার রাত বিরেতের গোপন প্রেম, আমার জন্য বাবলুর অদৃশ্য মমতা... । কিংবা রূম্পা’কে না পাওয়ার বেদনা ? কাউকে না-বলতে পারা কিছু অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ইতিহাস । এই সবকিছু খুব কি খারাপ ? আমার কাছে হঠাৎ করে কেন যেন আজকের এই হতাশা, গরম, লোডশেডিং -সবকিছু খুব অর্থবহ একটা কিছু হয়ে ধরা দেয় । দারিদ্র্যও কিছু সুখের অনুভূতি দিতে পারে তাহলে ! আমার আশ্চর্য লাগে । আচ্ছা, আমি খুব ধনী হলে নীপুর এই ভালবাসাটাকে এতটা স্পষ্ট করে দেখতে পেতাম কি ? আমি এক হাত বাড়িয়ে নীপুর পিঠে হাত রাখি । মুহূর্তের ছোঁয়াচেও আমার প্রতি নীপুর অসংজ্ঞায়িত প্রগাঢ়তর ভালবাসার আঘ্রান আমি টের পাই । নিজেকে আমার সুখী মানুষ বলে মনে হয় । নীপুর প্রিয় কবিতাটির কবির মত আমারও মনে হয়ঃ
মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক ।
সাদা মোমবাতি জ্বেলে
তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেখি ।
নারীকে বাহান্ন তীর্থ বলেছে শুনেছি এক কবি ।
আমি তার গর্ভগৃহ, সরু সিঁড়ি, সোনার আসন
চন্দনবটিতে থাকে কতটা চন্দন
দেখে গুনে গুনে মেপে দেখে
তবেই পাতাবো মৌরীফুল ।
সাদা মোমবাতি জ্বেলে
তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেখি ।
নারীকে বাহান্ন তীর্থ বলেছে শুনেছি এক কবি ।
আমি তার গর্ভগৃহ, সরু সিঁড়ি, সোনার আসন
চন্দনবটিতে থাকে কতটা চন্দন
দেখে গুনে গুনে মেপে দেখে
তবেই পাতাবো মৌরীফুল ।
‘ধুপ’ করে অকস্মাৎ কিসের শব্দ হয় । নীপুর হাত থেকে মোমবাতি খসে পড়ে নিভে যায় । আমি চমকে উঠে নীপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি । নীপু ‘ও মাগো’ বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে । আবারও বুঝি বাবলুর জোনাক-ওড়ানো বয়াম ভাঙলো ? কাঁচের যে বয়াম হাত ফসকে গেছে আমার জন্য ! নাকি আধগলা মোমবাতি পড়ার-ই শব্দ ? চেষ্টা করেও আমি কিছুতেই অন্য কিছু ভাবতে পারি না । আমি জেনেই যাই ছাদ থেকে কোন এক বোকা মেয়ে লাফ দিয়ে পড়েছে । যার সঙ্গে মৌরীফুল পাতালে হয়তোবা আজ রাতে সে... । না, আমি এসব ভাববো না । অন্যের স্বপ্ন নিয়ে অনেক ভেবেছি । এবার কিছুটা নিজেকে নিয়েও ভাবতে শিখতে হবে । আমি ভাববো নীপুর ভালবাসার কথা, জোনাকবন্দী হারিকেনটার কথা । তাও ভাবতে না পারলে নাহয় ছ’জনের এই ছন্নছাড়া সংসারটির কথাই ভাবলাম, যাকে মাসের ত্রিশ তারিখ পর্যন্ত কোনরকম করে টেনে নিয়ে যেতেই আমাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় । এর বাইরে ভাবতে আমি চাই না । আমি তো চাইলেই নতুন করে আরও একটি সমস্যাকে আপন করে নিতে পারি না !
আমি স্থির ভেবে নেই, জোনাকবন্দী যে কাঁচের বয়াম -ওটাই ভেঙে গুঁড়ি গুঁড়ি হয়েছে নিশ্চিত; কোন চেনাজানা রূপসীর মাথা নয় । যার বৃত্তে কোন একদিন আমার স্বপ্নগুলো নির্দ্বন্দ্বে
ঘোরাফেরা করত ।